যাকাত কি ? যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত সমূহ
আল্লাহ তায়ালার দাসত্ব ও আনুগত্য স্বীকার করে তাঁর আদেশ পালন ও নিষেধ বর্জন করে জীবন পরিচালনাকে ইসলামী পরিভাষায় ইবাদত বলা হয়। ইসলাম হলো পূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। ইসলামের মৌলিক পাঁচটি বিষয় কালিমা, নামাজ, রোজা, হজ্জও যাকাত যথাযথ পালনের নাম ইবাদত। আর মানব জীবনের প্রতিটি কাজ ইসলামী বিধি-বিধান অনুযায়ী সম্পন্ন করা ইবাদতের অংশ। পৃথিবীর সকল শ্রেষ্ঠ বস্তু মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আর মানুষ ও জিন জাতিকে শুধু আল্লাহ তায়ালার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আজকে নিম্নে যাকাতের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
সূচিপত্র: যাকাত কি ? যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত সমূহ
- যাকাত কি
- যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত সমূহ
- যাকাতের হিসাব
- উৎপন্ন শস্যের যাকাত
- মন্তব্য
যাকাত কি?
যাকাত আরবি শব্দ এর আভিধানিক অর্থ বৃদ্ধি পবিত্রতা পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি। ইসলামী পরিভাষায় ধনী ব্যক্তিদের নির্ধারিত পরিমাণ সম্পদ থাকলে নির্দিষ্ট অংশ গরিব ও অভাবী লোকদের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়াকে যাকাত বলে। যাকাত প্রদানের মাধ্যমে সম্পদ ব্যাক্তি বিশেষের হাতে পুঞ্জিভূত হয়ে থাকে না। আর মানুষের হাতে সম্পদ পুঞ্জিভূত থাকুক আল্লাহ তায়ালা তা পছন্দ করেন না। তিনি চান সম্পদ মানুষের কল্যাণের ব্যয় হোক সমাজের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হোক।এ বিবেচনায় যাকাত অর্থ বৃদ্ধি। যাকাত প্রদানের দাতার অন্তর কৃপণতা থেকে পবিত্র হয়।
বিত্তশালীদের সম্পদে দারিদ্র্যের অধিকার আছে। অবশিষ্ট সম্পদ ধনীদের জন্য পবিত্র হয়ে যায়। এদিক বিবেচনায় যাকাত অর্থ পবিত্রতা। যাকাত দিলে সম্পদে আল্লাহ বরকত দান করেন। ইসলামের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ রকনের মধ্যে যাকাত অন্যতম। কুরআন মাজিদে বহু জায়গায় সালাতের সাথে যাকাত আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন" আর তোমরা নামাজ কায়েম কর এবং যাকাত প্রদান কর"(সূরা আল মুযাম্মিল, আয়াত- ২০)
যাকাত হল দরিদ্রের অর্থ প্রদত্ত অধিকার, ধনীদের দয়া বা অনুগ্রহ নয় বরং এটি আদায় করা ধনীদের উপর ফরজ। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, "তাদের (ধনীদের) ধন-সম্পদের অবশ্যই দরিদ্র বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে। শরীয়তের বিধান অনুযায়ী নামাজ আদায় করলে আদায়কারীর জন্য যেমন পুরস্কারের ঘোষণা আছে তেমনি যাকাত আদায়কারীরও জন্য সুসংবাদ রয়েছে। যেমন যাকাত দিলে মাল পবিত্র হয় এবং সম্পদে আল্লাহ তায়ালা বরকত দেন।
যাকাত প্রদানকারীদের আখেরাতের অধিক পরিমাণ পুরস্কার দেওয়া হবে যা মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না। হাদিসে বর্ণনা রয়েছে আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাকে বলেন, হে বনি আদম আমার পথে খরচ করতে থাকো আমি আমার অফুরন্ত ভান্ডার থেকে তোমাদের দিতে থাকবো। যাকাত আদায়কারীদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন "আর আল্লাহ বলেন আমি অবশ্যই তোমাদের সাথে আছি যদি তোমরা নামাজ কায়েম করো এবং যাকাত দাও" (সূরা আল মায়দা আয়াত- ১২)
যাকাত দানকারীর পুরস্কার ও কৃপণ ব্যক্তির দুঃসংবাদ সম্পর্কে অন্য এক হাদিসে আছে "দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর নিকটবর্তী, জান্নাতের নিকটবর্তী, আল্লাহ বান্দাদের নিকটবর্তী এবং জাহান্নাম থেকে দূরবর্তি। অপরদিকে কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহ থেকে দূরে, আল্লাহর বান্দাদের থেকে দূরে এবং জাহান্নামের নিকটে। "একজন জাহিল দানশীল এর চেয়ে একজন কৃপণ আল্লাহর কাছে অনেক বেশি পছন্দনীয়" (তিরমিজি)
কেউ যদি সম্পদ জমা করে রাখে দরিদ্র বঞ্চিতের প্রাপ্য যথাযথভাবে আদায় না করে তাহলে কিয়ামতের দিন তাকে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে।
আরো পড়ুনঃ বাচ্চা হলে আযান দেওয়ার নিয়ম জেনে নিন
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত সমূহ:
১. মুসলমান হওয়া:
যাকাত ফরজ হওয়ার প্রথম শর্ত হলো মুসলমান হওয়া। অমুসলিমদের উপর যাকাত ফরজ নয়। কাজেই কোন ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করলে তাকে তার অতীত জীবনে যাকাত দিতে হবে না। যেদিন মুসলমান হবে সেদিন থেকে হিসাব করে যাকাত দিতে হবে।
২. নিসাবের মালিক হওয়া:
যে পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে শরীয়তে যাকাত ফরজ হয়, সে পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া।
৩. নিসাব পরিমাণ সম্পদ প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া:
যেসব দ্রব্যের উপর মানুষের জীবন যাপন নির্ভর করে সেসব জিনিসপত্রকে প্রয়োজনীয় দ্রব্য বলে। যেমন খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছেদ, বসবাসের বাড়িঘর, পেশাজীবীর যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। যানবাহনের নৌকা, সাইকেল, মোটর, পশু, কৃষি কাজের সরঞ্জাম, পড়ালেখা সরঞ্জাম এসব প্রয়োজনীয় জিনিসের অন্তর্ভুক্ত। এগুলোর উপর যাকাত ফরজ হবেনা।
৪. ঋণ গ্রস্থ না হওয়া:
ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেও তার ওপর যাকাত ফরজ হবে না। কারণ সে জীবন ধারণের মৌলিক প্রয়োজনেই ঋণ গ্রহণ করেছে। তবে ঋণ পরিশোধ করার পর যদি নিছাব পরিমাণ সম্পদ কারো কাছে থাকে তাহলে তাকে যাকাত দিতে হবে।
৫. মাল এক বছর কাল স্থায়ী থাকা:
নিসাব পরিমাণ সম্পদ ব্যক্তির হাতে এক বছর কাল স্থায়ী না হলে তার উপর যাকাত ফরজ হয় না। হাদিস আছে" ঐ সম্পদের যাকাত নেই, যা পূর্ণ একবছর মালিকানায় না থাকে"
৬. জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া:
যাকাত ফরজ হওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে জ্ঞান সম্পন্ন হওয়া। জ্ঞান বুদ্ধিহীন তথা পাগলের উপর যাকাত ফরজ নয়।
৭. বালেগ হওয়া:
যাকাত দাতা কে অবশ্যই বালেগ তথা প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে। শিশু নাবালেক যথা সম্পদের মালিকই হোক না কেন, বালেগ হওয়ার পূর্বে তার ওপর যাকাত ফরজ হয় না।
যাকাতের নিসাব:
নিসাব আরবি শব্দ। এর অর্থ নির্ধারিত পরিমাণ। শরীয়তের পরিভাষায় যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য সম্পদের নির্ধারিত পরিমাণকে নিসাব বলে। সারা বছর জীবন যাত্রার প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের পর বছর শেষে যার হাতে নিসা পরিমাণ সম্পদ উদ্বৃত্ত থাকে তাকে বলা হয় সাহিবে নিসাব বা নিসাবের মালিক। আর সাহিবে নিসবের উপরেই যাকাত ফরজ। নিসাবের পরিমাণ হলো সোনা কমপক্ষে সাড়ে সাত তোলা অথবা রুপা কমপক্ষে সাড়ে ৫২ তোলা অথবা ওই মূল্যের অর্থ বা সম্পদ।
ওই পরিমাণ সম্পদ কারণ নিকট পূর্ণ এক বছর স্থায়ী থাকলে ঐ সোনা রুপা বা সম্পদের মূল্যের 40 ভাগের এক ভাগ যাকাত দেওয়া ফরজ। কিন্তু সম্পদ নিসাবের কম থাকলে যাকাত দেওয়া ফরজ নয়। এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগে সম্পদ নষ্ট হয়ে গেলে যাকাত দিতে হবে না। কারো হাতে যদি বছরের প্রথমে হিসাব পরিমান সম্পদ থাকে বছরের মাঝে কোন কারণে নিসাব হতে কমে যায়।
এবং ঐ বছর শেষে আবার নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়ে গেলে তাকে যাকাত দিতে হবে। আর স্ত্রীলোকের ব্যবহার্য সোনা রুপার অলংকার জীবনের অত্যাবশ্যকীয় মৌলিক বস্তুর অন্তর্ভুক্ত নয়। কাজে অলঙ্কার নিসাব পরিমাণ হলে তাকে যাকাত দিতে হবে। সোনা রুপা ব্যতীত অন্য কোন ধাতব কাঁসা-পিতল ইত্যাদি ব্যবহার্য জিনিসের হিসাবে থাকলে যাকাত দিতে হবে না। তবে ব্যবসায়ী সামগ্রী হলে যাকাত দিতে হবে।
আরো পড়ুনঃঈমানের সাতটি বিষয় সম্পর্কে জেনে নিন
উৎপন্ন শস্যের যাকাত
ধান, গম, জব খেজুর ইত্যাদি শস্য শেচ প্রদান ছাড়া বৃষ্টির পানিতে জন্মালে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সব ফসলের ১০ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে বা আদায় করতে হবে। একে উশর বলা হয়। আর শেচ ব্যবস্থায় উৎপন্ন ফসলের ২০ ভাগের এক ভাগ যাকাত আদায় করতে হয়।
মন্তব্য:
প্রত্যেক মুমিন বান্দার উচিত পরকালে কঠিন শাস্তি থেকে মুক্তি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় যথা নিয়মে যাকাত আদায় করা। অন্যকে যাকাত দানে উৎসাহিত করা। ইসলামী বিধান মত যাকাত আদায় করে সমাজের অসহায় দারিদ্র্যের অবস্থার উন্নতি করা।
শেষের কথা
আমরা উপরোক্ত বিষয়টি পরে জানতে পারলাম যাকাত কি যাকাতের ফরজ যাকাতের নিসাব এবং উৎপন্ন শস্যের যাকাত সম্পর্কে। আমরা যাকাতের বিষয়ে সচেষ্ট থাকব। আমাদের মাঝে কোন জিনিসের ওপর যাকাত ফরজ হয়ে গেলে সেই জিনিসের উপর যাকাত প্রদান করব। যাকাতের নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে আমাদের অবশ্যই যাকাত প্রদান করতে হবে। আশা করি বিষয়টা আপনাদের মাঝে ক্লিয়ার হয়েছে। প্রিয় পাঠক বন্ধুরা দেখা হবে অন্য কোন বিষয় নিয়ে এবং ইসলামের শরীয়তের অন্য কোন কনটেন্ট নিয়ে। পোস্টটি ভাল লাগলে অবশ্যই বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করে জানিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো। ধন্যবাদ।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url